যাকাতের গুরুত্ব ও হাকীকত

ইসলামিক প্রবন্ধ ‘যাকাতের গুরুত্ব ও হাকীকত’

ইসলামের অন্যতম রোকন যাকাত

ইসলামের তৃতীয় রোকন বা স্তম্ভ হলো যাকাত। যাকাত ইসলামের কত গুরুত্বপূর্ণ রোকন তা বোঝার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, কোরআন শরীফে আল্লাহ তা'আলা যখনই বলেছেন আকীমুছ ছালাত, তোমরা সালাত কায়েম কর তখনই সঙ্গে সঙ্গে বলছেন, ওয়া আতুয্ যাকাত, আর তোমরা যাকাত আদায় করো।


যাকাত আদায় না করা মুমিনের কাজ নয়

কুরআনের বর্ণনা এটা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, সালাত আদায় না করা যেমন মুমিনের কাজ নয়, তেমনি যাকাত আদায় না করাও মুমিনের কাজ নয়, বরং দু'টোই মুশরিকের কাজ। যেমন সালাত সম্পর্কে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-

وَتَّقُوْهُ وَاَقِيْمُ الصَّلَوٰۃَ وَلاَ تَكُوْنُوْا مِنَ الْمُشْرِكِیْنَ{٣١}

'আর তোমরা তাঁকে ভয় করো, আর সালাত কায়েম কর, আর মুশরিকদের দলে গণ্য হয়ো না।' [ রূম-৩১]

একইভাবে যাকাতের ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে -

قُلۡ  اِنَّمَاۤ  اَنَا بَشَرٌ  مِّثۡلُکُمۡ  یُوۡحٰۤی  اِلَیَّ اَنَّمَاۤ  اِلٰـہُکُمۡ  اِلٰہٌ  وَّاحِدٌ فَاسۡتَقِیۡمُوۡۤا اِلَیۡہِ وَ اسۡتَغۡفِرُوۡہُ ؕ وَ وَیۡلٌ  لِّلۡمُشۡرِکِیۡنَ

 الَّذِیۡنَ  لَا یُؤۡتُوۡنَ الزَّکٰوۃَ وَ ہُمۡ بِالۡاٰخِرَۃِ  ہُمۡ کٰفِرُوۡنَ

আপনি বলুন, আমি তো তোমাদেরই মত মানুষ, (পার্থক্য শুধু এই যে,) আমার কাছে অহী পাঠনো হয়েছে এ মর্মে যে, তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ্। সুতরাং তোমরা তাঁর পথে দৃঢ়ভাবে অটল থাকো এবং তাঁর কাছে ক্ষমা চাও। আর মুশরিকদের জন্য ধ্বংস, যারা যাকাত দেয় না। আর তারাই আখিরাতের অস্বীকারকারী। [হা-মীম সাজদাহ, ৬-৭]

 

সংকটময় মুহুর্তে খলিফা আবু বকর (রাযি.) এর যাকাতের প্রতি গুরুত্ব

এ ঘটনা থেকেও যাকাতের শরী'আতের দৃষ্টিতে যাকাতের মহাগুরুত্ব অনুধাবন করা যায়, যে, পেয়ারা নবী (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর কিছু গোত্র সালাত আদায় করলেও যাকাত আদায় করতে রাজি হলো না। এরা আসলে ইসলামের বিজয় যাত্রায় প্রভাবিত হয়ে মুসলমান হয়েছিল ; ঈমান তাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি।

যাই হোক, খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করলেন, অথচ তখন পরিস্থিতি এতই নাযুক ছিলো যে, বাহ্যত জিহাদ করার কোন সামর্থ্য উম্মতের ছিলো না। হযরত ওমর (রা.) এর মত কঠোর প্রকৃতির মানুষ অনুরোধ করেছিলেন ঐ লোকদের প্রতি কিছুটা নমনীয় হতে। কিন্তু ছিদ্দীকে আকবর (রা.), যিনি ইরতিদাদের ফিতনার সময় বলেছিলেন, আমি বেঁচে থাকবো, আর দ্বীনের ক্ষতি হবে?! তিনি দ্ব্যার্থহীন ভাষায় ঘোষণা করলেন, তারা যদি ঐ রশিটাও দিতে অস্বীকার করে যা নবী (সা.) এর যামানায় আদায় করতো তাহলেও আমি তাদের  বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবো। হযরত ওমর (রা.) কে তিনি যুক্তি দিয়ে বিষয়টি বুঝালেন। তখন তিনি ও অন্যান্য ছাহাবা কেরাম তাঁর সঙ্গে একমত হলেন। (বুখারী, হাদীস নং ৭২৮৫; মুসলিম, হাদীস নং ২০)


যাকাতের হাকীকত কী?

আধুনিক যুগের মুসলিম বুদ্ধিজীবিদের বিরাট অংশ সম্ভবত যুগের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে, বরং অন্যান্য জাতির ভয়ে ভীত ও হীনমন্যতার শিকার হয়ে আরকানে ইসলামের ক্ষেত্রে রাজনীতি, অর্থনীতি, স্বাস্থ্যনীতি ও সমাজনীতির আধুনিক পরিভাষা ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। 

তারা মনে করে, এভাবে তারা ইসলামের বিরাট খেদমত করছে। তাদের সরলতার প্রতি সত্যি করুণা হয়। তারা বুঝতেই পারে না যে, এভাবে ইসলামের কত বড় সর্বনাশ করা হচ্ছে। যাকাতের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা দেখা যায়। তাদের লেখা থেকে বোঝা যায়, যাকাত একটি অর্থনৈতিক বিধান, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে দারিদ্রবিমোচন। এর পর তারা গর্ব করে অন্যান্য জাতির উদ্দেশ্যে বলে, দারিদ্র্যবমোচনের জন্য ইসলাম যে অর্থনৈতিক বিধান জারি করেছে এর চেয়ে উত্তম, এর চেয়ে ন্যায়ভিত্তিক ও ইনছাফপূর্ণ ব্যবস্থা পৃথিবাতে অন্য কোন অর্থব্যবস্থায় পেশ করা সম্ভব হয়নি। এভাবে আসলে যাকাতের মূল প্রাণ, আসল হাকীকত ও রূহ হারিয়ে যায়। 


যাকাতের মূল উদ্দেশ্য

তারা ভুলে যায় যে, যাকাতের আসল হাকীকত হচ্ছে ইবাদত ও বান্দোগী এবং আল্লাহর মুহব্বত, নৈকট্য ও ভালোবাসা অর্জনের ঐকান্তিক আকুতি। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে লোভ-লালসা, সম্পদলিপ্সা, কৃপণতা এবং অন্তরের নির্দয়তা ও নিষ্ঠুরতা, এসকল রোগ-ব্যাধি হতে বান্দার কলবকে পাকছাফ করা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও কবুলিয়াত, অতপর গরীব-মিসকিনের ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা ও দু'আ অর্জনের মাধ্যমে মালের মধ্যে বরকত পয়দা করা। এসব উদ্দেশ্যই কোরআন-সুন্নায় গুরুত্বসহকারে বলা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে

خُذْ مِنْ أَمْوٰلِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِم بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ ۖ إِنَّ صَلٰوتَكَ سَكَنٌ لَّهُمْ ۗ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

আপনি তাদের মাল থেকে ছাদাকা গ্রহণ করুন, যা দ্বারা আপনি তাদের পবিত্র করবেন এবং সংশোধন করবেন। আর আপনি তাদের জন্য দু'আ করুন, নিঃসন্দেহে আপনার দুআ তাদের জন্য শান্তির কারণ আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। (তাওবা, ৯ : ১০৩)

হযরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে

আল্লাহ তাআলা যাকাত ফরয করেছেন শুধু এজন্য যে, তোমাদের অবশিষ্ট মাল যেন যেন উত্তম ও পবিত্র হয়ে যায়। (আবু দাউদ, ১৬৬৪)

তবে হাঁ, এই মৌলিক ও বুনিয়াদি উদ্দেশ্যের পরে জাগতিক দিক থেকেও কিছু পার্শ্ব-উদ্দেশ্য অবশ্যই রয়েছে। যেমন দরিদ্রদের মৌলিক প্রয়োজন পূর্ণ করা এবং ধনী-গরীবের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনা এবং উভয় শ্রেণীর মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষের পরিবর্তে প্রীতি ও সম্প্রীতির সম্পর্ক সৃষ্টি করা।

হযরত মুআয বিন জাবাল (রা.) কে যখন ইয়ামানে প্রেরণ করা হচ্ছিলো তখন আখেরি হিদায়াত দিয়ে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম বলেছিলেন ‘তুমি তাদের অবহিত করো যে, আল্লাহ তাদের উপর ছাদাকাহ’ ফরয করেছেন যা তাদের ধনিদের থেকে নেয়া হবে, আর তাদের গরীবদের দিকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। (বোখারী, বাবু ওজুবিয-যাকাত, হাদীছ নং ১৩৯৯)

এগুলো অবশ্যই যাকাতের উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত, তবে স্তরতারতম্য অবশ্যই মনে রাখতে হবে। পূর্ববর্তী ওলামায়ে উম্মত, যারা দ্বীনের ছহীহ বুঝ, তথা ফিকহ ফিদ্দীন অর্জন করেছেন তাঁদের লেখায় ও বক্তব্যে এ বিষয়টি পরিষ্কার ছিলো উদ্দেশ্যের স্তরতারতম্য হৃদয়ঙ্গম করতে ব্যর্থ হলে ফেতনার প্রবল আশঙ্কা।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url